গণতন্ত্র টিকিয়ে রাখতে হলে রাজনীতি চর্চা করা অপরিহার্য, রাজনীতি ব্যতিরেকে গণতন্ত্র চিন্তা করা যায় না, পৃথিবীব্যাপী গণতন্ত্রের যাত্রার শুরু হতেই রাজনীতি এবং রাজনৈতিক দলসমূহ সামনে থেকে নেতৃত্ব প্রদান করে আসছে। পৃথিবীব্যাপী যখন সাম্রাজ্যবাদের জয়জয়কার চলছে, ঠিক তখনই গণতন্ত্রের ধারণার যাত্রা শুরু হয়েছিল প্রাচীন গ্রীসে। খ্রিস্টপূর্ব ৫ম শতাব্দীতে এথেন্স শহর-রাষ্ট্রে গণতন্ত্রের প্রথম উদাহরণ পাওয়া যায়। এটি ছিল “ডাইরেক্ট ডেমোক্রেসি” বা সরাসরি গণতন্ত্র, যেখানে সব পুরুষ নাগরিক সরাসরি সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করতেন।
তবে আধুনিক গণতন্ত্রের সূচনা ঘটে ১৭শ ও ১৮শ শতকে ইউরোপে। বিশেষ করে, ইংল্যান্ডে ম্যাগনা কার্টা (১২১৫) এবং পরবর্তীতে আমেরিকার স্বাধীনতা ঘোষণা (১৭৭৬) ও ফরাসি বিপ্লব (১৭৮৯) গণতান্ত্রিক চিন্তার ভিত্তি স্থাপন করে। (ত. সূ. : উইকিপিডিয়া )
বাংলাদেশে গণতন্ত্রের যাত্রা শুরু হয়েছিল পাকিস্তান থেকে স্বাধীনতার মাধ্যমে ১৯৭১ সালে, যদিও এর ভিত্তি আরও আগে রাজনৈতিক আন্দোলন ও ভোটাধিকারের মাধ্যমে তৈরি হয়েছিল। ৭০, ৮০, ৯০ এর দশক ও বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে বাংলাদেশের রাজনীতি ছিল দলীয় কর্মসূচি, মিছিল, মিটিং , গণসংযোগ, পোষ্টার , ফেস্টুন, লিফলেট, ব্যানার , উচ্চস্বরে মাইক বাজিয়ে প্রচারণা ও ভোটারদের বাড়ি বাড়ি যাওয়ার কর্মসূচি নির্ভর, সে সময় চা এর দোকান কিংবা গ্রাম্য বাজারগুলো ও ছিল রাজনীতি চর্চার অন্যতম স্থান। তবে বিশ্ব প্রযুক্তি বিপ্লবের সাথে তাল মিলিয়েই বিংশ শতাব্দীর শুরুর কিছুটা পরে বাংলাদেশেও এর ব্যবহার পরিধি ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। রাজনৈতিক দলসমূহ প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক প্রচার প্রচারণা শুরু করে। রাজনৈতিক দল এর পাশাপাশি সরকারিভাবে ও প্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহার শুরু হয়। সর্বশেষ নির্বাচনী ব্যবস্থায় ব্যালট ভোটার পদ্ধতির পরিবর্তে ইউভিএম বা ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিন এর সংযুক্তি তার উদাহরণ। যদিও এর ব্যবহার বিধি নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। এছাড়াও রাজনৈতিক দল সমূহের প্রান্তিক পর্যায়ের যোগাযোগ এর পরিধি প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে সহজ ও দূরতম হয়েছে।
গত স্বৈরাচার পতনের আন্দোলনেও ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার এর ফলে আন্দোলনরত দের কখনো দমিয়ে রাখা যায় নি, তারা ডিজিটাল প্রযুক্তির মাধ্যমে দেশের জনগণের প্রতি বার বার বিভিন্ন রূপরেখা উপস্থাপন করেছেন, যখন প্রিন্ট বা ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার ভূমিকা ছিল নির্বাক ও স্বৈরাচারী সরকারের সহযোগী রূপে। দীর্ঘ এক মাসের বেশি সময়ের এই আন্দোলনে স্বৈরাচার ও তার আজ্ঞাবহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মারমুখী অবস্থানের জন্য মাঝে মাঝে আন্দোলন বন্ধ থাকলেও, আন্দোলনকারীরা নিজেদের মধ্যে পরবর্তী করণীয় এবং সুযোগ বুঝে সমউপযোগী রূপরেখা প্রণয়ন করেন। যেখানে ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার অত্যাধিক লক্ষণীয়। পতিত স্বৈরাচার ইন্টারনেট সেবা বন্ধের মাধ্যমে তাদের এই ডিজিটাল আন্দোলনও ব্যাহত করার চেষ্টা করেছে। সর্বশেষ ৫-আগস্ট ছাত্র জনতার জয়ের মাধ্যমে ডিজিটাল প্রযুক্তির ও জয় হয়েছে।
বিশ্ব রাজনীতির দিকে তাকালে দেখা যাবে সেখানে এই ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহারের হার আমাদের তুলনায় অনেকাংশে বেশি। এই যেমন গতমাসে অনুষ্ঠিত মার্কিন যুক্তরাষ্টের নির্বাচনে প্রায় ৮৯% ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার করা হয়েছে। ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার করে দেশের বাহিরে অবস্থানরত নাগরিকদের ভোট প্রদান করতে দেখা গেছে।
বাংলাদেশ এর বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এর নির্বাচনী সার্চ কমিটির এমন একটি প্রস্তাব রয়েছে, যে ডিজিটাল প্রযুক্তির মাধ্যমে দেশের বাহিরে অবস্থানরত নাগরিকদের যেনো ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ দেওয়া হয়।
রাজনীতিতে ডিজিটাল প্রযুক্তির অনেক সুফল যেমন রয়েছে তেমনি এর কুফল ও কিন্তু কম না, একটি গবেষনায় দেখা গেছে ভুল তথ্য ও গুজব সব থেকে বেশি ছড়ানো হয় ডিজিটাল প্রযুক্তির মাধ্যমে। যা মানুষের কাছে সহজে পৌঁছায় এবং বিভক্তি তৈরী্ করে, এমন কি ভুল তথ্য ও গুজব ছড়ানোর মাধ্যমে সংঘর্ষের সৃষ্টি হচ্ছে।
তবে রাজনীতিতে রাজনৈতিক দল ও জনগণের মধ্যে ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার এর মাধ্যমে যে গতির সৃষ্টি হয়েছে যদি তার সঠিক ব্যবহার করা যায় তবে তা ভবিষ্যৎ গণতন্ত্রের জন্য মঙ্গল বয়ে আনবে।
মোঃ হাসান শেখ
শিক্ষার্থী এমএসএস,
রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ ,
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়।