রাজধানীর বাড্ডার মূর্তিমান আতঙ্ক গোল্ডেন মনির তার অপরাধ জগতের সাম্রাজ্য ফিরে পাওয়ার জন্য নতুন মিশনে নেমেছেন। ২০২০ সালে গোল্ডেন মনিরকে গ্রেফতার করেছিল র্যাব। বিভিন্ন ধরনের জালিয়াতি, চোরাচালান এবং দুর্নীতির বিষয়ে প্রমাণ পাওয়ার পর গোল্ডেন মনিরকে গ্রেফতার করা হয়। এরপর প্রায় ৩ বছর জেল খেটে সম্প্রতি জামিনে বের হয়ে এসে রাজকীয়ভাবে তার সাম্রাজ্য চালিয়ে যাচ্ছেন। এ অবস্থায়ও চলছে তার দুর্বৃত্তায়ন, অপকর্ম। বাড্ডা এলাকার বিভিন্ন ক্ষেত্রে কলকাঠি নেড়ে অশান্ত পরিবেশ সৃষ্টি করে জানান দিচ্ছেন তিনি এখনো আছে কে এই গোল্ডেন মনির : নব্বইয়ের দশকে মনির হোসেন গাউছিয়া মার্কেটে একটি কাপড়ের দোকানে বিক্রয়কর্মী হিসাবে কাজ করতেন। পরে তিনি রাজধানীর মৌচাকের একটি ক্রোকারিজের দোকানে কাজ শুরু করেন। তখন ‘লাগেজ পার্টি’র একজনের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। এরপর মনিরও লাগেজ ব্যবসায় যুক্ত হন। এই লাগেজ ব্যবসা করতে গিয়ে শীর্ষ সন্ত্রাসী মুরগি মিলনের সঙ্গে পরিচয় হয়। চতুর মনির একটা সময় শীর্ষ সন্ত্রাসী মুরগি মিলনের আস্থা ও বিশ্বাস অর্জন করের, যে কারণে তাকে ক্যাশিয়ার হিসাবে নিয়োগ দেয়। শীর্ষ সন্ত্রাসী মুরগি মিলনের মৃত্যুর পর তার চোরাকারবারি সাম্রাজ্য গোল্ডেন মনিরের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। এই নিয়ে শীর্ষ সন্ত্রাসী মুরগি মিলনের অনুসারীদের সঙ্গে গোলাগুলি পর্যন্ত হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে গোল্ডেন মনিরের বাসায় গুলি করে যা পরবর্তী বাড্ডা থানায় জিডি হয় এবং গোল্ডেন মনির একাধিক গানম্যান নিয়ে চলাফেরা করতেন নিজেকে রক্ষা করার জন্য। এভাবেই তিনি লাগেজ পার্টি আর সোনা চোরাকারবারিদের গডফাদার হয়ে ওঠেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক গোল্ডেন মনিরের ঘনিষ্ঠ সহযোগী জানায়, সে বিদেশ থেকে গাড়ি আমদানির আড়ালে গাড়ির তেলের টাংকির ভেতরে বিশেষ প্রক্রিয়ায় স্বর্ণ নিয়ে আসে, পরে সেগুলো তার ডিআইটি প্রজেক্টের গ্যারেজে আনলোড করে। এছাড়া শুল্ক ফাঁকি দিয়ে বিভিন্ন সংসদ সদস্যের নামে দামি গাড়ি নিয়ে এসে যোগসাজশে বিক্রি করে। বর্তমানে একজন সংসদ সদস্যের গাড়ি সে ব্যবহার করছে, দুবাই-সিঙ্গাপুরেও রয়েছে তার আলাদা সাম্রাজ্য, সেখানে মনির দেশ থেকে প্রচুর পরিমাণ টাকা হুন্ডির মাধ্যমে পাচার করেছে। গোয়েন্দা সূত্রে জানা যায়, মূলত ঢাকা-সিঙ্গাপুর-ভারত রুটে ছিল তার মূল ব্যবসা। মুরগি মিলনের কাজ করার সময় স্বর্ণ চোরাকারবারে জড়িয়ে পড়েন গোল্ডেন মনির। অবৈধভাবে দেশে নিয়ে আসেন বিপুল পরিমাণ স্বর্ণ। বায়তুল মোকাররম মার্কেটে তিনি একটি স্বর্ণের গহনার দোকানও দেন। চোরাচালানের স্বর্ণ ওই দোকান থেকে বিক্রি হতো বলেও অভিযোগ রয়েছে।স্বর্ণ চোরাচালান ব্যবসার মধ্যেই ২০০১ সালে বিএনপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর মনির জমির ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েন। গোল্ডেন মনিরের উত্থান ঘটে লুৎফুজ্জামান বাবর যখন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী হন তখন। এর মাঝে গণপূর্ত ও রাজউকের সঙ্গে তার সম্পর্ক গাঢ় হয়। এখান থেকেই গোল্ডেন মনির ফুলেফেঁপে ওঠেন এবং বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে তিনি বিপুল বিত্তের মালিক হন। গামছা বিক্রেতা থেকে জমির ব্যবসার ‘মাফিয়া’ হয়ে ওঠেন মনির। ২০০৭ সালে চোরাচালানের দায়ে তার বিরুদ্ধে বিশেষ ক্ষমতা আইনে একাধিক মামলা হয়। বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর আওয়ামী লীগের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করেছিলেন গোল্ডেন মনির, কিন্তু সে চেষ্টা সফল হয়নি। এরপর আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কাছে খবর ছিল যে, বিভিন্ন নাশকতার ঘটনায় গোল্ডেন মনিরের হাত রয়েছে। আর সেই প্রেক্ষিতেই ২০২০ সালের ২১ নভেম্বরের অভিযানে তাকে গ্রেফতার করা হয়। র্যাবের অভিযানে গোল্ডেন মনির হিসাবে পরিচিত কথিত স্বর্ণ ব্যবসায়ী মনির হোসেনের বাড়ি থেকে উদ্ধার করা হয় নগদ ১ কোটি ৯ লাখ টাকা, চার লিটার মদ, ৮ কেজি স্বর্ণ, একটি বিদেশি পিস্তল এবং কয়েক রাউন্ড গুলি। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা সূত্রে জানা যায়, কার্যত সোনা চোরাচালানই ছিল মনিরের ব্যবসা। পরে তিনি জড়িত হন জমির ব্যবসায়। হুন্ডি ব্যবসা, স্বর্ণ চোরাচালান, ভূমিদস্যুতার মাধ্যমে অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়েছেন তিনি। মনির ঢাকা ও আশপাশে গত ২ দশকে শতাধিক প্লটের মালিক হন। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে মনির ৩৫টি প্লটের কথা স্বীকার করেছে। জমির ব্যবসায় নেমে রাজউকের বর্ধিত ভবনে একটি অফিস খুলে বসে সে, সেখান থেকে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ শুরু করে। রাজউকের তদবির, জমির কাগজ তৈরি, নকল ফাইল তৈরি করাসহ বিভিন্ন ধরনের কাজ করতে থাকে। রাজউকের বহু প্লট তার দখলে। রাজউকের ৭০টি ফ্ল্যাটের নথি নিয়ে গিয়ে আইনবহির্ভূতভাবে হেফাজতে রাখায় ২০১৯ সালে মনিরের বিরুদ্ধে রাজউক কর্তৃপক্ষ মামলা করে। এছাড়া দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল সম্পদ অর্জন করায় তার বিরুদ্ধে দুদকের মামলাও চলমান। বেশকিছু প্রতিষ্ঠানের মালিকানার সঙ্গে জড়িত এই গোল্ডেন মনির। তার মধ্যে রয়েছে-মনির বিল্ডার্স, গালফ অটোকারস লিমিটেড, উত্তরার গ্র্যান্ড জমজম টাওয়ার। এসব প্রতিষ্ঠানের অন্যতম পরিচালক এই গোল্ডেন মনির। জমজম টাওয়ারে মনিরের মালিকানার মূল্যমান প্রায় ৫০০ কোটি টাকা। বারিধারায় গোল্ডেন গিয়ার নামে কয়েক কোটি টাকা মূল্যের গাড়ির যন্ত্রাংশের দোকান রয়েছে তার। বাড্ডার ১০ ও ১১ নম্বর সড়কে সাড়ে তিন কোটি টাকা মূল্যের দুটি এবং দুই কোটি টাকা দামের প্লট রয়েছে। উত্তরা ১১ নম্বর সেক্টরে মনিরসহ চারজনের অংশীদারত্বে প্রায় ১০০ কোটি টাকা মূল্যের পাঁচ বিঘা জমি রয়েছে। এর বাইরে কেরানীগঞ্জে প্রচুর জমিজমা ও প্লট আছে। দখলে রয়েছে স্কুল : রাজউকের জমিতে মনির হোসেন ওরফে গোল্ডেন মনির প্রাইভেট শিক্ষাবাণিজ্য গড়ে তুলেছেন। মেরুল বাড্ডা দক্ষিণ বারিধারা আবাসিক পুনর্বাসন প্রকল্পে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য জনস্বার্থে একটি মসজিদ, একটি বিদ্যালয়, একটি কলেজ ও একটি খেলার মাঠের জন্য রাজউক জমি বরাদ্দ দেয়। কিন্তু গোল্ডেন মনির রাজউকের কতিপয় দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজশে নামমাত্র মূল্য ৫০ টাকা কাঠা দরে মোট ১৫ কাঠা ৪ ছটাক জমির প্লটটি সর্বমোট মূল্য ৭৬৫ টাকা প্রদান করে বরাদ্দ নেন। প্লটটিতে এলাকার সাধারণ বাসিন্দাদের ছেলেমেয়েদের স্বল্প খরচে পড়াশোনার সুযোগ করে দেওয়ার কথা থাকলেও গোল্ডেন মনির সম্পূর্ণ একক মালিকানাধীন একটি বেসরকারি স্কুল স্থাপন করেন। প্রতিবছর ভর্তির সময় প্রতিটি ছাত্রছাত্রীর কাছ থেকে ২০০০০ টাকা এবং মাসিক বেতন হিসাবে ২৪৫০ টাকা আদায় করে থাকে। যা ওই প্লট বরাদ্দের শর্তের পরিপন্থি। ফলে এই এলাকার মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানদের স্বল্প খরচে শিক্ষা প্রদানের সুযোগ অধরাই রয়ে গেছে। অপরদিকে সরকারি নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে গোল্ডেন মনির বাণিজ্যিক ও ব্যক্তিগত লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করে বিপুল টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। তিনি জেল থেকে বের হয়ে আরও অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছেন বলে জানায় এলাকাবাসী। এ বিষয়ে গোল্ডেন মনিরের সঙ্গে বিভিন্ন উপায়ে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও কথা বলা সম্ভব হয়নি।